
শাবান মাসে প্রিয়নবীর আমল
শাবান মাস শরয়ী বিধি-বিধানের দৃষ্টিতে মাহে রমযানের ভূমিকা। কেননা এর পরপরই রমযানের পবিত্র মাস আগত। এ মাসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু বিশেষ আমল রয়েছে।
প্রথম আমল : রমযান পর্যন্ত হায়াত লাভের দোয়া*
প্রথম আমল হলো, যখন শাবানের চাঁদ দেখা দিত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দোয়া পড়তেন।
اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلّغنا رمضان
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। অর্থাৎ আমাদের হায়াত এ পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিন, যাতে আমরা রমযান মাস পেয়ে যাই এবং তার বরকত লাভ করতে পারি।
দ্বিতীয় আমল : বেশি বেশি রোযা রাখা*
আম্মাজান হযরত আয়শা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসে খুব বেশি রোযা রাখতেন। তাই এ মাসকে রমযানের প্রস্তুতি মনে করতে পারেন, রোযার অনুশীলনও মনে করতে পারেন। আর রমযানের ইস্তেকবালও মনে করতে পারেন। এগুলো নফল রোযা। ফরজ বা ওয়াজিব নয়। তবে এ মাসের যে কোনো দিন রোযা রাখা অন্য মাসের সাধারন দিনগুলোতে রোযার চেয়ে বেশি ফযীলত রাখে। এক্ষেত্রে রোযা রাখার দিন তারিখ নির্দিষ্ট নেই। সংখ্যাও নির্ধারিত নেই। বরং এ মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সময়ই তাওফীক হয় নফল রোযা রাখবে। হযরত আয়শা রা. বলতেন, শারিরীক কারণে রমযান মাসে আমার যেসব রোযা কাযা হয়ে যেত আমি সেগুলোর কাযা শাবান মাসে করতাম। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও রোযা রাখতেন। তাই আমার জন্য রোযা রাখা সহজ হয়ে যেত। এর দ্বারা শাবানের রোযার ফযীলত বুঝা যায়।
অবশ্য সাথে সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন, রমযানের সামান্য পূর্বে তথা এক-দুই দিন পূর্বে রোযা রাখা উচিত নয়। এর একটি কারণ ওলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন, এটা এ জন্য যাতে মানুষ রমযানের রোযাগুলো উদ্যোমের সহিত আদায় করতে পারে। আগে থেকে রোযা রেখে ক্লান্ত না হয়ে পরে।
দ্বিতীয় কারণটি আরো সূক্ষ। তাহলো, দীন অনুসরণের নাম। আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নিষেধের অনুসরণের নাম। নিজের খেয়াল-খুশি ও সখ পুরা করার নাম দীন নয়। এজন্য বেদআতকে গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা বেদআতের মধ্যে নিজের মনপুত কোনো বিষয়কে দীন সাব্যস্ত করা হয়। তাতে আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের অনুসরণ হয় না। তাই শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে রমযানের এক-দুইদিন পূর্বে রোযা রাখা বন্ধ করে দাও। কারণ, এক-দুই দিন পূর্বে রোযা রাখলে ধরা হবে যেন, তুমি নিজের পক্ষ থেকে রোযার মধ্যে বৃদ্ধি করেছ। আল্লাহ তাআলা তো তোমার উপর ত্রিশ রোযা ফরজ করেছেন। তুমি তার সাথে যুক্ত করলে শাবানের শেষের আরো দুই রোযা। এতে রোযা বত্রিশটি হয়ে গেল। ফরজের মধ্যে বৃদ্ধি হলো। শরীয়ত এ বিষয়ে খুব করাকরি আরোপ করে, কেউ যেন আল্লাহ তাআলার ফরজের মধ্যে কমও না করে, বেশিও না করে।
একইভাবে আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন, শরীয়তের নির্দেশ হলো, একেবারে শেষ সময়ে সাহরী খাওয়া। আর সূর্য অস্তে যাওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা। কেননা যদি দুই ঘন্টা আগেই সাহরী খেয়ে অবসর হয়ে যাও বা সূর্য্য অস্ত যাওয়ার পরও ইফতারী করতে বিলম্ব কর তাহলে নিজের পক্ষ থেকে রোযার পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটানো হবে।
এর থেকে অনুমাণ করা যায় শরীয়ত কত সূক্ষভাবে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, কোনো মানুষ যেন নিজের পক্ষ থেকে দীনের মধ্যে বৃদ্ধি না করে। চাই সেটা বাহ্য দৃষ্টিতে যত সুন্দরই মনে হোক। ইবাদত মনে হোক। কিন্তু আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত তরীকার খেলাপ হওয়াতে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সওয়াবের তো প্রশ্নই আসে না। উল্টো গুনাহ হবে।
তৃতীয় আমল : শবেবরাতে ইবাদত-বন্দেগী
শাবানের চৌদ্দ ও পনের তারিখের মাঝামাঝি রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী । একে আমাদের এখানে সাধারণভাবে শবেবরাত বলা হয়। ভিবিন্ন বর্ণনা দ্বারা এর ফযীলত প্রমাণিত।
শবেবরাতেরর হাকীকত
এক শ্রেণির লোক মনে করেন, এ রাতের ফযীলত কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ রাতে জেগে থাকা, তাতে বিশেষভাবে ইবাদত-বন্দেগী করা এবং তা সওয়াবের বিষয় মনে করা ভিত্তিহীন। কেউ কেউ তো এ রাতে ইবাদত করাকে বেদআত পর্যন্ত বলে ফেলছেন। তাই মানুষের মনে এ রাত সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে। অতএব এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা সংগত মনে করছি।
অনুসরণের নাম দীন
আমি আপনাদেরকে বার বার বলেছি, যে জিনিস কুরআন-সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও বুজুর্গানেদীনের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়, তাকে দীনের অংশ মনে করাই বিদআত। আমি সব সময় এ কথা বলে আসছি, নিজের পক্ষ থেকে একটি পথ-পদ্ধতি তৈরি করে তার উপর চলার নাম দীন নয়। দীন হলো অনুসরণের নাম। কার অনুসরণ করবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ, সাহাবাদের অনুসরণ, তাবেয়ীদের অনুসরণ ও বুজর্গানেদীনের অনুসরণ। অতএব বাস্তবেই যদি এ রাতের ফযীলত প্রমাণিত না হয় তবে নিঃসন্দেহে এর ব্যাপারে বিশেষ গুরাত্বারোপ করা বেদআত হবে। যেমন, শবে মেরাজের ব্যাপারে আমি বলেছি। শবে মেরাজে বিশেষ কোনো ইবাদতের কথা কুরআন-হাদীসে নেই।
এ রাতের ফযীলত ভিত্তিহীন নয়
কিন্তু বাস্তবতা হলো, শবেবরাতেরর ফযীলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়- এ কথা ঠিক নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ রাতের ফযীলত বর্ণিত আছে। আর এমন হাদীস দশজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো হাদীস সনদের বিবেচনায় দুর্বল বটে। এ সুবাদেই কতিপয় আলেম মন্তব্য করেছেন, এ রাতের ফযীলত ভিত্তিহীন। কিন্তু মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের সিদ্ধান্ত হলো, যদি কোনো বর্ণনা সনদের বিবেচনায় দুর্বল হয়, কিন্তু তার সমর্থনে অন্য আরো হাদীস থাকে তাহলে তার দুর্বলতা বাকি থাকে না। আমি বলেছি, দশজন সাহাবী থেকে এ রাতের ফযীলতের হাদীস বর্ণিত। অতএব দশজন সাহাবী থেকে বর্ণিত বিষয়কে ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট আখ্যায়িত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শবেবরাত এবং খাইরুল কুরুন [শ্রেষ্ঠ যুগ]
মুসলিম জাতির খাইরুল কুরুন [শ্রেষ্ঠ যুগ] তথা সাহাবা, তাবেয়ীন এবং তাবে তাবেয়ীনের যুগেও এ রাতকে ফযীলতের রাত হিসেবে পালন করা হত। লোকেরা এ রাতের ইবাদতের প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতেন। অতএব এটাকে বেদআত, বানোয়াট বা ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয়। সঠিক কথা হলো, এটি ফযীলতপূর্ণ ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রজনী। এ রাতে জাগ্রত থাকা ফযীলতের কাজ। এ রাতে ইবাদত বন্দেগীতে বিশেষ সওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে।
বিশেষ কোনো ইবাদত নির্দিষ্ট নেই
এটাও ঠিক যে, এ রাতে ইবাদতের বিশেষ কোনো তরীকা নেই। যেমন, কেউ কেউ নিজেদের থেকে একটি তরীকা গড়ে বলে থাকে, শবেবরাতের বিশেষ পদ্ধতিতে নামায আদায় করতে হয়। প্রথম রাকাতে অমুক সূরা এত সংখক পড়তে হয়। দ্বিতীয় রাকাতে অমুক সূরা এত সংখক পড়তে হয়। অথচ এর কোনো প্রমাণ নেই। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ রাতে যত সম্ভব নফল ইবাদত করবে। নফল নামায পড়বে। কুরআন তিলাওয়াত করবে। যিকির ও তাসবীহ পাঠ করবে। দোয়া করবে। এ সবই করা যাবে। কিন্তু এর বিশেষ কোনো পদ্ধতি নেই।
এ রাতে গোরস্তানে যাওয়া
এ রাতের আরেকটি আমল আছে। বিষয়টি একটি হাদীসে উল্লেখ আছে। তা হলো, এ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকীতে গিয়েছিলেন। এর থেকে মুসলমানরাও এ রাতে কবর যিয়ারতে গিয়ে থাকেন। কিন্তু আমার পিতা হযরত মুফতী শফী রাহ. একটি কাজের কথা বলতেন। কথাটি সব সময় স্মরণ রাখার মতো। তিনি বলতেন, যে বিষয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে পর্যায়ে প্রমাণিত, তাকে সেই স্তরেই রাখা উচিত। বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোটা জীবনে এক শবেবরাতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেহেতু একবার যাওয়ার কথা পাওয়া যায় তাই তুমিও জীবনে যদি একবার যাও তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু যদি প্রতি শবেবরাতে গুরুত্বের সাথে কবরস্তানে যাওয়া হয়, একে আবশ্যক মনে করা হয়, শবেবরাতের গুরুত্বের একটি অংশ ভাবা হয়। কবরস্তানে যাওয়া ছাড়া শবেবরাতই হয় না এমন ধারণা করা হয় তাহলে তা হবে বাড়াবাড়ি। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতের অনুসরণে জীবনের এক শবেবরাতে কবরস্তানে গমন করলে তা হবে সওয়াবের কাজ। কখনো কখনো না যাওয়াও চাই। সব সময় যাওয়ার নিয়ম বানিয়ে নেয়া যাবে না। জরুরিও মনে করা যাবে না। দীনকে যথাযথ বুঝার অর্থ এটাই। যে জিনিস যে স্তরের, তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতে হবে। বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
নফল নামায বাড়িতে পড়বে
শুনেছি, অনেকে এ রাতে এবং কদরের রাতে জামাতের সাথে নফল নামায পড়েন। প্রথম দিকে শুধু শবিনা জামাতের সাথে পড়া হত। এখন সালাতুততাসবীহও জামাতে পড়া হয়। অথচ সালাতুততাসবীহ এর জন্য জামাত নেই। এটি জামাতে পড়া নাজায়েয। এ ব্যাপারে একটি মূলনীতি শুনুন! মূলনীতিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তাহলো, ফরজ নামায এবং যেসব নামায রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাতের সাথে আদায় করেছেন, যথা : তারাবীহ, বিতর এবং ইসতিস্কা ইত্যাদির নামায -এ সকল নামায ছাড়া অবশিষ্ট সব ধরনের নফল নামায বাড়িতে পড়া উত্তম। ফরয নামাযের বৈশিষ্ট্য হলো, তা জামাতের সাথে আদায় করা শুধু উত্তমই নয়; বরং ওয়াজিবের কাছাকাছি, সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আর সুন্নত ও নফলের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, এগুলো নিজ ঘরে আদায় করবে। কিন্তু ফুকাহায়ে কেরাম লক্ষ্য করলেন, মানুষ ঘরে গিয়ে অনেক সময় সুন্নত আর পড়ে না। তাই তারা এ কথাও বলেছেন, ঘরে গেলে সুন্নত ছুটে যাওয়ার আশংকা থাকলে মসজিদেই পড়ে নিবে। সুন্নত যেন ছুটে না যায়; তাই এ কথা বলেছেন। যদিও নিয়ম হলো সুন্নত ঘরে পড়া। নফলের ব্যাপারে ফকীহগণের ঐকমত্য হলো তা ঘরে আদায় করা উত্তম। নফলের জামাত হানাফী মাযহাবে মাকরূহে তাহরীমী এবং নাজায়েয। জামাতে নফল নামায পড়লে সওয়াব তো নয়ই, উল্টো গুনাহ হবে।
ফরজ নামায জামাতে আদায় করবে
আসল কথা হলো, ফরজ নামায শিআরে ইসলাম বা ইসলামের নিদর্শন। তাই তা জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করা জরুরি। কেউ যদি মনে করে, মসজিদে জামাতে নামায আদায় করলে ‘রিয়া’র আশংকা রয়েছে তাই ঘরে নামায পড়ে নিই, এরূপ করা জায়েয নয়। কারণ, বিধান হলো, ফরজ নামায মসজিদে গিয়ে পড়তে হবে। এর মাধ্যমে ইসলামের একটি শিআর ও শক্তি প্রকাশ করা উদ্দেশ্য। সুতরাং তা মসজিদেই আদায় করতে হবে।
নফল নামাযে নির্জনতা কাম্য
নফলের সম্পর্ক বান্দা ও প্রভুর সাথে। এখানে তুমি আর তোমার প্রভু থাকবে। হযরত আবু বকর রা.-এর ঘটনা বর্ণিত আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এত আস্তে তেলাওয়াত করেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন أَسْمَعتُ مَنْ نَاجَيْتُ
অর্থাৎ যে মহান সত্তার সাথে আমি একান্তে আলাপ করছি তাকে তো শুনিয়েছি। সুতরাং অন্য মানুষকে শুনানোর কি প্রয়োজন?
তাই নফল নামাযে নিয়ম হলো, বান্দা এবং প্রভুই থাকবেন। মাঝে কেউ প্রতিবন্ধক হবে না। আল্লাহ চান, আমার বান্দা সরাসরি আমার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করুক। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মহাপুরস্কার। তাই নফল নামায জামাতে কিংবা সম্মিলিতভাবে পড়া মাকরূহ।
আমার কাছে নির্জনে এসো
রাজা-বাদশাহদের দুটি দরবার থাকে। এক. আম দরবার। আর জামাতে নামায হলো, আল্লাহর আম দরবার। দুই. খাস দরবার। এটা হয় নির্জনে ও একাকী। আল্লাহর খাস দরবার বান্দার জন্য মহাপুরস্কার। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- যখন তুমি আমার আম দরবারে হাজিরা দিয়েছ, তোমাকে খাস দরবারেরও নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখন কেউ যদি এই নির্জন দরবারকে লোকারণ্য করে দেয় তাহলে সে এই খাস দরবারের অবমূল্যায়ন করল। আল্লাহ বলছেন, নির্জনে এসে চুপিসরে আলাপ কর। আমি নির্জনে তোমাকে দেব। অথচ তুমি দলবল নিয়ে উপস্থিত হলে। এটা শোভনীয় নয়।
নেয়ামতের অবমূল্যায়ন
ধর, তুমি কোনো রাজা-বাদশাহর সাক্ষাতে গেলে। বাদশাহ বললেন, আজ রাত নয়টা বাজে একাকী আমার নিকট আসবে। তোমার সাথে কিছু প্রাইভেট কথা আছে। রাত নয়টা বাজলে তুমি বন্ধু-বান্ধদের একটি দল নিয়ে দরবারে হাজির হলে। এবার বল, তুমি বাদশাহর কথার মূল্যায়ন করলে, না অবমূল্যায়ন? বাদশাহ তোমাকে প্রাইভেট সাক্ষাতের সুযোগ দিয়েছিলেন, সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে। তুমি সদলবলে গিয়ে তার অবমূল্যায়ন করলে।
এজন্য ইমাম আবু হানীফা রহ. বলতেন, নফল ইবাদতের সঠিক মূল্য দাও। এর সঠিক মূল্য হলো, তুমি থাকবে আর তোমার আল্লাহ থাকবেন। তৃতীয় কেউ থাকতে পারবে না। এটাই নফল ইবাদতের বিধান। নফল ইবাদত জামাতের সাথে করা মাকরূহে তাহরীমী। আল্লাহর আহ্বানের প্রতি লক্ষ করুন
ألَا هَلْ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ فَأَغْفِرَ لَهُ
অর্থাৎ আছ কি কোনো মাগফিরাত প্রত্যাশী, আমি তাকে মাফ করে দেব। এখানে مُسْتَغْفِرٍ শব্দটি একবচন। অর্থাৎ একক ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? একক রহমত প্রত্যাশী আছ কি? এখানে আল্লাহ শুধু আমাকে নির্জনে ডাকছেন। আর আমি শবিনার নামে, আলোকসজ্জা করে লোকদেরকে দাওয়াত দিলাম তোমরাও আমার এ নির্জনতায় শরীক হয়ে যাও। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর পুরস্কারের অবমূল্যায়। তাই শবিনা হোক, সালাতুততাসবীহর জামাত হোক কিংবা অন্য কোনো নফল জামাত হোক সবই নাজায়েয।
একান্ত মুহূর্তগুলো
ফযীলতের এ রাত শোরগোলের জন্য নয়। এটি মেলা বা সম্মেলনের রাতও নয়। এ রাত হলো, আল্লাহর সাথে একান্তে সম্পর্ক গড়ার রাত। যেখানে তোমার এবং প্রভুর মাঝে কোনো অন্তরায় থাকবে না। কবি বলেন-
ميان عاشق و معشوق رمزيست + كرامًا كاتبين را ہم خبر نيست
অর্থাৎ আশেক ও মাশুকের মাঝের গোপন রহস্য কিরামান কাতিবীনেরও অজানা থেকে যায়।
অনেকে অভিযোগ করেন, একাকি ইবাদত করতে গেলে ঘুম চলে আসে। মসজিদে যেহেতু লোকজনের সমাগম থাকে, বাতি জ্বলে, শবিনা হয়, তাই মসজিদে ইবাদত করলে ঘুম কাবু করতে পারে না। বিশ্বাস করুন! অল্প সময়ও যদি নির্জনে আল্লাহর সহিত প্রেম ও ভাব বিনিময় করা যায় তা সারা রাত ইবাদতের চেয়ে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ। কারণ, নির্জনে যে সময় কেটেছে তা সুন্নত অনুযায়ী কেটেছে। আর লোক সমাগমে যে সময় কাটবে তা সুন্নত পরিপন্থী কাটবে। সারা রাত এমন ইবাদত করাও এখলাসের সহিত নির্জনে কয়েক মুহূর্ত রিয়ামুক্ত ইবাদতের সমান নয়।
সময়ের পরিমাপ বিবেচ্য নয়
আমি সব সময় বলে থাকি, নিজের বুঝ অনুযায়ী কাজ করার নাম দীন নয়। আর নিজ বাসনা পূর্ণ করার নামও দীন নয়। বরং দীনি শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করার নাম হলো দীন। তুমি মসজিদে কয় ঘন্টা কাটালে আল্লাহ তাআলা তা গণনা করবেন না। সেখানে কোনো ঘন্টার হিসাব নেই। সেখানে দেখা হয় এখলাস। এখলাসের সাথে কয়েক মুহূর্ত আল্লাহর সম্পর্ক লাভের সুযোগ হলে তাই নাজাতের জন্য যথেষ্ট। পক্ষান্তরে সুন্নত পরিপন্থী ইবাদত কয়েক ঘন্টা হলেও লাভ নেই।
এখলাস কাম্য
আমার শায়খ ডা. আবদুল হাই রহ. আবেগের অতিশয্যে বলতেন, তোমরা যখন সেজদা কর, سُبْحَانَ رَبِّيّ الأَعْلَى কত বার বল? তোমরা তো যন্ত্রের মতো سُبْحَانَ رَبِّيّ الأَعْلَى উচ্চারণ কর। কোনো দিন এখলাসের সহিত এক বারও যদি অন্তর থেকে سُبْحَانَ رَبِّيّ الأَعْلَى বের হয়ে যায় তাই নাজাতের জন্য যথেষ্ট।
তাই এমনটি কিছুতেই ভাবা উচিত নয়, একা ঘরে ইবাদত করলে ঘুম চলে আসবে। ঘুম এসে গেলে শুয়ে পড়। পরে সামান্য সময় ইবাদত করলেও তা সুন্নত অনুযায়ী কর। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত হলো, তেলাওয়াতের সময় ঘুম চলে আসলে ঘুমিয়ে পড়। সামান্য ঘুমিয়ে ঘুমের রেশ কেটে গেলে এবার উঠে তেলাওয়াত কর। যাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তেলাওয়াতকালে মুখ দিয়ে কোনো ভুল শব্দ বের না হয়। একজন সুন্নত পরিপন্থী সারা রাত জাগরন করল, অপরজন সুন্নত মুতাবিক মাত্র এক ঘন্টা জেগেছে, সে প্রথম ব্যক্তির চেয়ে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ।
সকল ইবাদত সীমারেখার ভেতর রাখবে
আল্লাহর দরবারে আমল গণনা করা হয় না। তিনি দেখেন ওজন। তাই গণনা হিসেবে তুমি বহু ইবাদত করলেও, তাতে ওজন না থাকলে কোনো দাম নেই। ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো বাড়াবাড়ি করা যাবে না। যে আমল যেভাবে এসেছে সেভাবেই করতে হবে। যে ইবাদত জামাতের সহিত যে পরিমাণ সাব্যস্ত সে পরিমাণই কর। যেমন, ফরজ নামাযের জামাত আছে। রমযান মাসে তারাবীহ ও বিতর নামাযের জামাত আছে। একইভাবে জানাযার নামাযের জামাত ওয়াজিব আলাল কেফায়া। দুই ঈদের নামাযের জন্যও জামাত প্রমাণিত। ইসতিসকা ও কুসুফের নামায সুন্নত হলেও তাতে জামাতের বিধান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত।
তাছাড়া শিআরে ইসলাম হওয়ার কারণেও এই দুই নামাযে জামাতের বিধান রয়েছে। এই সব নামায ছাড়া যত নামায আছে, কোনোটিতে জামাত নেই। এগুলোতে আল্লাহ চান বান্দা তার সাথে নির্জনে সাক্ষাত করুক। এটা বান্দার জন্য বিশেষ মর্যাদা। এ মর্যাদার কদর করা উচিত।
মহিলাদের জামাত
মহিলাদের জামাতের ব্যাপারে মাসআলা হলো, তাদের জন্য জামাত করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অপসন্দনীয়। ফরজ, সুন্নত ও নফল সব নামাযে একই বিধান। আল্লাহ নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন একান্তে ইবাদত করতে। আমি আগেও বলেছি দীন মূলত অনুসরণের নাম। তাই এ কথা বলা যাবে না, আমাদের তো এইভাবে ইবাদত করতে মন চায়। এই মনের চাওয়াকে বর্জন করতে হবে। মনে তো অনেক কিছুই চায়। তা বলে তা তো দীন হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা যা পছন্দ করেননি তা মন-বাসনার দরুন করা উচিত নয়।
শবেবরাত এবং হালুয়া
শবেবরাত ফযীলতের রাত। এ রাতে যত সম্ভব ইবাদত করবে। এ রাতে হালুয়া-রুটি পাকানোর যে অহেতুক রসম চালু হয়েছে, এর সাথে শবেবরাতের কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে শয়তান সবখানেই ভাগ বসাতে চায়। সে ভাবল, এ রাতে মুসলমানদেরকে ক্ষমা করা হয়। যেমন, এক বর্ণনায় এসেছে, এ রাতে ‘কাল্ব’ গোত্রের বকরী পালের পশম পরিমাণ মানুষের গুনাহ মাফ করা হয়। শয়তান চিন্তা করল, এত মানুষের গুনাহ মাফ করা হলে তো আমি হেরে গেলাম। তাই সে নিজের ভাগ বসাল। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করল, শবেবরাত আসলে হালুয়া-রুটি তৈরি কর। নামায পড় বা না পড়, ইবাদত কর বা না কর শবেবরাতে হালুয়া-রুটি অবশ্যই পাকাতে হবে। না পাকাইলে ভৎষণা করা হয়- অমুকের ঘরে শবেবরাতেরও হালুয়া-রুটি পাক হয় না। সে তো সাংঘাতিক কৃপন।
এমনিতে সারা বছর কোনো দিন হালুয়া পাকানো নাজায়েয নয়। যার মন চায় সে পাকিয়ে খেতে পারে। কিন্তু শবেবরাতের সাথে এর সম্পর্ক কী? কুরআন, সুন্নাহ, আছারে সাহাবা, তাবেয়ী ও বুজুর্গানে দীনের আমলে এর কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। এটা শয়তানের পাতা ফাঁদ। মানুষকে পাক-সাক ও খাওয়াতে লাগিয়ে দিছে। হালুয়া-রুটি পাকানোর যে গুরুত্ব ইবাদতেরও সে গুরুত্ব নেই।
বিদআতের বৈশিষ্ট্য
একটি বিষয় সব সময় মনে রাখবেন। আমার আব্বাজান মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. বলতেন, বেদআতের বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ যখন বেদআতে লিপ্ত হয় তখন আসল সুন্নতের তাওফীক কমে যায়। দেখবেন, শবেবরাতের যারা দীর্ঘ সময় সালাতুততাসবীহ জামাতের সাথে পড়ে, তাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাযের জামাতে কম দেখা যায়। যারা বেদআত তথা হালুয়া-রুটি তৈরিতে ব্যস্ত থাকে তাদের নামায কাযা হয়ে যায়, জামাত ছুটে যায়। অথচ তার কোনো চিন্তা নেই।
কারো ইন্তেকাল হয়ে গেলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল গুরুত্বারোপ করেছেন, জলদি শরীয়ত মোতাবেক তার মিরাছ বন্টন করতে। এখন হচ্ছে উল্টো। মিরাছ বন্টনের কোনো খেয়াল নেই। তৃতীয় দিনের, দশম দিনের অনুষ্ঠান, চল্লিশা এবং মৃত্যুবাষিকী ঠিকই পালন হচ্ছে।
বেদআতের বৈশিষ্ট্য হলো, যখন মানুষ তাতে লিপ্ত হয় সুন্নত তার থেকে দূরে সরে যায়। সুন্নতের উপর আমল করার তাওফীক হয় না। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। মোটকথা, এসব অহেতুক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু এ রাত ফযীলতের রাত। যারা বলেন, এ রাতের কোনো ফযীলত নেই তাদের ধারণা ঠিক নয়।
আতশবাজি
দ্বিতীয় বিষয়টি প্রথমটি থেকে আরো খারাপ। সেটি হলো শবেবরাতে আতশবাজির প্রচল শুরু হয়েছে। এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এই আতশবাজির মাধ্যমে অনেক সময় বহু নিষ্পাপ জান ধ্বংশ হয়ে যায়। করাচীর মৌলভী বাজার আজো সাক্ষী হয়ে আছে। কোনো এক শবেবরাতের আতশবাজির ধ্বংশলীলার সাক্ষী হয়ে আছে। গোটা বাজার পুরে ধ্বংশ হয়ে গেছে। হালুয়া-রুটি পাকানো তো সাধারন দিনে জায়িয। কিন্তু এভাবে আতশবাজি করা যাতে টাকার অপচয় হয়, মানুষের জান-মালের ক্ষতির আশংকা থাকে তা তো সাধারন দিনেও জায়িয নেই। বরং হারাম। তো এই মোবারক রাত যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা করা হয় এ ধরনের অহেতুক গুনাহর কাজ পরিহার করা চাই।
দুই ব্যক্তির ক্ষমার অযোগ্য
এ রাত এবং শবে কদর উভয়টির ব্যাপারে একটি বর্ণনায় এসেছে, তাতে কাল্ব গোত্রের বকরীর পশম পরিমাণ লোকদেরকে ক্ষমা করা হয়। কাল্ব আরবের একটি বিশাল গোত্র। তাতে অনেক বকরী ছিল। প্রত্যেক বকরীর গায়ে অসংখ্য পশম হয়। তো পুরা গোত্রে সমস্ত বকরীর গায়ে যে পরিমাণ পশম সে পরিমাণ লোকদের ক্ষমা করা হয়। কিন্তু বলা হয়েছে, দুই জন লোককে ক্ষমা করা হয় না।
এক. বিদ্বেষ পোষণকারী
প্রথম ক্ষমার অযোগ্য হলো, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের প্রতি কীনা-বিদ্বেষ রাখে। কীনার অর্থ অকারণে কারো অমঙ্গল কামনা বা কাউকে কষ্ট দেয়া বা লাঞ্চিত করার ফিকিরে থাকা। আল্লাহ তাআলা কোনো মুসলমানের প্রতি কীনা রাখা থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন।
আরে ভাই! কারো থেকে কোনো ভুল হয়ে থাকলে তাকে বলে দাও। তার সাথে সমস্যার সমাধান করে নাও। শরীয়ত তো এই হকও দিয়েছে, সে যতটুকু কষ্ট দিয়েছে ততটুকু বদলা নিয়ে নিবে। কিন্তু অন্তরে কীনা রাখা, তার প্রতি অমঙ্গল কামানা করা এবং তাকে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করা এমন মারাত্মক গুনাহ যা এ রাতেও ক্ষমা করা হয় না।
দুই. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী
দ্বিতীয় ক্ষমার অযোগ্য হলো, যে টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পায়জামা, প্যান্ট বা লুঙ্গি ইত্যাদি পরিধান করে।
আজকাল মানুষ এতে ব্যাপক হারে লিপ্ত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর থেকে হেফাজত করেন। হাদীসে এসেছে, এটা তাকাব্বুরের আলামত। আল্লাহ তাআলা তাকাব্বুরকে কোনোভাবে সহ্য করেন না। তিনি বলেন।
الكبرياء ردائي فمن نازعني ردائي قصمته
অর্থাৎ বরত্ব প্রকাশ আমার চাদড়। যে আমার চাদড় নিয়ে টানাটানি করবে আমি তার ঘাড় মটকিয়ে দিব।
সুতরাং তাকাব্বুর মারাত্মক গুনাহর কাজ। আর এভাবে কাপড় পড়া তাকাব্বুরের প্রতীক। এজন্য এর থেকে বারন করেছেন এবং তাকে ক্ষমার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। আসলে এতে তো এমন কোনো ফায়দাও নেই। শুধু শুধু আল্লাহর রাসূলের হুকুমের বিরোধিতা হবে।
শাবানের পনের তারিখের রোযা
বরাতের রাতের পরের দিন ১৫ শাবান সম্পর্কেও একটি মাসআলা জেনে রাখা দরকার। তাহলো, বরাতের রাতের পরের দিন রোযা রাখার কথা হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে শুধু একটি বর্ণনায় এসেছে। এ বর্ণনাটি আবার দুর্বল। তাই অনেক আলেম বলেছেন, এ বর্ণনার ভিত্তিতে বিশেষভাবে ১৫ শা’বানের রোযাকে সুন্নত বা মুস্তাহাব বলা ঠিক নয়। অবশ্য গোটা শা’বান মাসে রোযা রাখার ফযীলত প্রমাণিত। অর্থাৎ শা’বানের এক তারিখ থেকে সাতাশ তারিখ পর্যন্ত রোযা রাখার ফযীলত আছে। তবে আটাশ ও উনত্রিশ তারিখের রোযা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ রমযানের এক দুই দিন পূর্বে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। যাতে রমযানের রোযার জন্য মানুষ স্বাচ্ছন্দের সাথে প্রস্তুত থাকতে পারে।
তাছাড়া শা’বানের এই পনের তারিখ আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্ত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত প্রতি মাসের আইয়ামে বীয তথা ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখতেন। তাই এটা এক দিকে শা’বানের ১৫ তারিখ, অপর দিকে আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি এই দুই কারণে রোযা রাখে তাহলে ইনশাআল্লাহ সওয়াবের অধিকারী হবেন। কিন্তু বিশেষভাবে ১৫ শা’বানের রোযাকে সুন্নত বলা- এটা অনেক আলেমের মতে ঠিক নয়। এ কারণেই ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার অধ্যায়ে ১০ মুহাররম এবং আরাফার দিনের রোযা উল্লেখ করলেও ১৫ শা’বানের রোযার কথা উল্লেখ করেন নি। বরং বলেছেন, শা’বানের যে কোনো দিন রোযা রাখা উত্তম। এই দৃষ্টিকোন থেকে কেউ রোযা রাখলে সে সওয়াব লাভ করবে বটে, কিন্তু এখানে নির্দিষ্ট কোনো তারিখের বিশেষত্ব নেই।
আমি আগেও বলেছি, প্রত্যেক জিনিসকে তার নির্ধারিত সীমায় রাখা জরুরি। দীন মূলত সীমারেখা রক্ষারই নাম। নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কম বেশি করার নাম দীন নয়। তাই শা’বানের ১৫ তারিখের রোযা যে পর্যায়ের সে পর্যায়েই রাখতে হবে। তাকে বিশেষ সুন্নত সাব্যস্ত করা যাবে না।
তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলুন
এই হলো, শবেবরাত এবং তার রোযার ব্যাপারে সারসংক্ষেপ আলোচনা। এ কথাগুলো সামনে রেখে আমল করা চাই। এর বাইরে তর্ক-বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। বর্তমানের সমস্যা হলো, কেউ কিছু বললেই সে ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। আসলে হওয়া দরকার ছিল, নির্ভরযোগ্য লোক থেকে কিছু শুনলে বিনা দ্বিধায় তার উপর আমল করা। অন্য কেউ ব্যতিক্রম বললেও তার সাথে বিতর্কে না জড়ানো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর্কে জড়াতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম মালেক রহ. বলেন, المرَاءُ يُطْفِئُ نُوْرَ الإِيْمَانِ অর্থাৎ এ ধরনের বিষয়ে পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক ইলমের নূর নষ্ট করে দেয়। আমাদের বিগত দিনের এক কবি আকবর ইলাহাবাদীর এ বিষয়ে চমৎকার একটি কবিতা আছে-
مذہبى بحث ميں نے كى ہى نہيں + فالتو عقل مجھ ميں تهى ہى نہيں
অর্থাৎ মতবাদগত আলোচনা আমি মোটেই করিনি। অহেতুক জিনিসের পিছনের পড়ার ফুরসত আমার নেই।
মতবাদ নিয়ে অযথা তর্ক-বিতর্কে সময় নষ্ট হয়। যাদের ফালতু বুদ্ধি আছে তারা এ সবে জড়ায়। তাই আমরা বলি, যে আলেমের প্রতি তোমার আস্থা রয়েছে তার কথা অনুযায়ী চল। ইনশাআল্লাহ! মুক্তি পাবে। অন্য আলেম ভিন্ন কথা বললে তাতে তর্কে জড়ানোর দরকার নেই। এটাই সঠিক রাস্তা।
রমযান আসছে পবিত্র হও!
সারকথা হলো, এ রাতের ফযীলতকে ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয়। আমার তো মনে হয় আল্লাহ তাআলা শবেবরাতকে রমযানে দুই সাপ্তাহ আগে দিয়ে মাহে রমযানকে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করেছেন। রমযানের রিহার্সেল এবং প্রস্তুতির ব্যবস্থা করেছেন। তৈরি হয়ে যাও। পবিত্র মাস আসছে, যাতে রহমতের বারিধারা বর্ষিত হয়। যাতে আমি ক্ষমার দরজা খুলে দেই, সে মাসের জন্য প্রস্তুত হও।
মানুষ কোনো বড় দরবারে যাওয়ার পূর্বে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। গোসল করে। কাপড় ধৌত করে। অতএব আল্লাহর শাহী দরবার যখন উন্মুক্ত করা হচ্ছে, সেই দরাবারের জন্য প্রস্তুত হও। এর জন্য একটি রাত ব্যয় কর। আল্লাহ বলছেন, আস! তোমাকে গোসল দিয়ে গুনাহ থেকে পবিত্র করে দিচ্ছি, যাতে আমার সাথে যথাযথভাবে তোমার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে। গুনাহ মুক্ত হয়ে গেলে রমযানের রহমত-বরকত দ্বারা সঠিকভাবে উপকৃত হতে পারবে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা আমাদেকে এ রজনী দিয়েছেন। এর মূল্যায়ন করা দরকার। আল্লাহ আমাদেরকে এ রাতের মূল্যায়ন করা এবং তাতে ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক দান করুন।
মূল: শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা.
অনুবাদ: মুফতী মুহাম্মদ আব্দুল মালেক