জ্ঞানগত পদস্খলন: করণীয় ও বর্জনীয়

 

জ্ঞানচর্চার ইতিহাস যতটা পুরোনো, জ্ঞানগত পদস্খলনের ইতিহাসও ঠিক ততটাই প্রাচীন। এই অনাকাঙ্খিত বিচ্যুতিকে সবসময় তরান্বিত করেছে যে নিয়ামক, তার অন্যতম প্রধান হচ্ছে জ্ঞানগত আত্নতৃপ্তি। নিজের অনুধাবন গুলোকে নিখুঁত, অনুসরণযোগ্য ভাবার হাস্যকর বাতিক।

ইলম আহরণের ময়দানে ধোঁকাবাজির প্রথম যে পদ্ধতিটা শয়তান প্রয়োগ করে তা হলো, সুন্দর সুন্দর অপূর্ণ ও ভুল চিন্তা ভাবনাগুলোকে কিয়াস, ইজতিহাদ, ইলমী বিশ্লেষনের খোলসে তালিবুল ইলমের (শিক্ষার্থীর) অন্তরে ঢেলে দেয়া। শিক্ষার্থীদেরকে আত্নমুগ্ধ করে তোলা।

আসলে নিজের অনুভব ও সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষের দূর্বলতা আজন্ম। মূর্খ থেকে বুদ্ধিজীবী কেউই এ থেকে মুক্ত নয়। কথাটা ইবলিসের অজানা নয়। তাই চিরকালই সে সফলতার সিড়ি হিসেবে আমাদের এই দূর্বলতাকেই বেছে নেয়। আত্মমর্যাদা ও জ্ঞানগত উন্মেষের খোসা লাগিয়ে এই ভয়ংকর, আত্নবিধ্বংসী দূর্বলতাকে জ্ঞান চর্চাকারীদের হৃদয়ে আরো শানিত ও চাঙ্গা করে তোলে। তৈরী করে অন্য যে কারো বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনাকে অনধিকার চর্চা সাব্যস্ত করার প্রান্তিক প্রবণতা। ফলে ধীরে ধীরে তার মন মস্তিষ্ক বিভিন্ন প্রকার বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অসংখ্য বাতিল চিন্তার জঞ্জালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার বিবেক।

নিজের একপেশে, ঠুনকো, ভিত্তিহীন, বুদবুদ সদৃশ্য বুঝকেই তখন শরীয়তের কাঙ্ক্ষিত কাঠামো মনে হয়। ইসলামী মনস্তত্ত্বের গভীর প্রকাশ বলে মনে হয়। মাকাসিদে শরীয়াহ বলে ভ্রম হয়। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি দিনের দিনের পর দিন আপাতসুন্দর অজ্ঞতার চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে থাকে। নেক সূরতের এই ধোঁকায় সে এগিয়ে যেতে থাকে পথভ্রষ্টতার পথে। কেউবা বেরিয়ে যায় আহলুস সুন্নাহের গণ্ডি থেকেই।

তাই নিজেকে গড়তে চাইলে প্রত্যেক জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির জন্য বুনিয়াদী জিম্মাদারী হচ্ছে নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দেয়া। উন্নাসিক মানসিকতা ও আত্নমুগ্ধতা কাটিয়ে উঠে নিজের অসীম মূর্খতাকে স্বীকার করা এবং প্রাজ্ঞদের বিপরীতে নিজস্ব বিশ্লেষন ও সিদ্ধান্তের তুচ্ছতা, অপরিপক্কতা উপলব্ধির সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। আত্নউপলব্ধির বিপরীতে আহলুস সুন্নাহের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের স্বিকৃত মতামতকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বোতভাবে প্রাধান্য দেয়া। এবং অবশ্যই প্রত্যক্ষভাবে সত্যিকারের নিষ্ঠাবান, মুত্তাকী পরহেযগার আল্লাহভীরু, ইসলাম সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী, আহলুস সুন্নাহের চিন্তাধারার পরিপূর্ণ ধারক, মু’তাদিল (প্রান্তিকতামুক্ত, চিন্তাগত ভারসাম্যের অধিকারী) কোন আলিমের অধীনে বা সান্নিধ্যে নিজেকে সোপর্দ করা। ইলমী ও আমলী (জ্ঞান ও কর্মগত) ব্যাপারে তার পরামর্শ ও নির্দেশনাকে নিজস্ব অপূর্ণাঙ্গ বুঝের বিপরীতে শিরোধার্য মনে করা।

নিজের চিন্তা কাঠামোকে যে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনা সে কখনোই ভালো বিশ্লেষক, দূরদর্শী নেতা ও সত্যিকারের জ্ঞানী হতে পারেনা।
তাই শিক্ষার্থীদের উচিত নিজের প্রতিটি চিন্তুা ও কল্পনা, বিভিন্ন বিষয়ে নৈতিক অবস্থান, শরীয়তের ব্যাপারে নিজের প্রতিটি বুঝ, অপরিপক্ক মাথায় উদয় হওয়া সমস্ত বিশ্লেষনী সিদ্ধান্তগুলোকেই শাইখের (গুরুর) সামনে পেশ করে তাসহীহ তানকীহ(শুদ্ধ পরিচ্ছন্ন) করে নেয়া।

ইনশাআল্লাহ এতে করে যে কোন জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তি, তালিবুল ইলম ও সাধারণ আলিমদের পথভ্রষ্ট হওয়ার, সিরাতে মুস্তাকীম থেকে ছিটকে পড়ার, অর্জিত জ্ঞান ভুল খাতে বা অপাত্রে ব্যায় হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশেই কমে যাবে।

সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে বিগত চৌদ্দশত বছরের সমস্ত মুসলিম স্কলারই এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন। নিজেদেরকে সালেহীন ওলামাদের (আল্লাহভীরু মনিষীদের) সান্নিধ্যে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। আমরা চাই আমাদের এই প্রজন্মও সোহবতের (জ্ঞানীদের সান্নিধ্যের) ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিতে শুদ্ধ ও পরিশীলিত হোক। আত্নশুদ্ধি ও জ্ঞানগত শুদ্ধির সমন্বয়ে আলোকিত হোক সকল সত্যান্বেষীর পবিত্র হৃদয়।

আল্লাহ্ তায়ালা ইলম পিপাসু সকল ভাই বোনদেরকে আত্নপ্রবঞ্চনা, জ্ঞানগত তৃপ্তি থেকে রক্ষা করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *