সূরা আল বাকারাহ-এর ১৮৭ নং আয়াতটি আমার জীবনে কিছু ফান্ডামেন্টাল শিক্ষা দিয়েছিল।
শুরুতে আয়াতটির তরজমা দেখে নেওয়া যাক— //রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরণ কর। আর পানাহার করো যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমূহ মানুষের জন্য বর্ণনা করেন, যাতে তারা বাঁচতে পারে।//
দীর্ঘ আয়াত। অনেক হুকুম বিবৃত হয়েছে এই এক আয়াতে। পূর্ণ আয়াত যে একসাথে নাযিল হয়েছে—তাও না। বরং সময়ের প্রেক্ষিতে খণ্ড খণ্ড হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। এমনকি “ভোরের” শব্দটাও পৃথক ওহি-তে অবতীর্ণ!
আয়াতটিকে জড়িয়ে অনেক আলোচনা আছে।
আজ থেকে প্রায় আট বছর আগের কথা। কুরআন তরজমার ক্লাসে ছাত্রের আসনে বিনীত হয়ে বসে আছি। আমি তখন সদ্য যৌবনে পা দেওয়া এক কিশোর মুমিন, যার ভেতর ঈমানের নূরে প্রোজ্জ্বল হলেও বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান শূন্য। (এবং এখনও শূন্য)।
উস্তাদ আলোচনা শুরু করলেন। এক-এক করে আয়াত সংশ্লিষ্ট সব কথাই বলে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে বললেন–
হারিস ইবনু সিরমাহ রাযি. নামে এক সাহাবি ছিলেন। তিনি খেতের কাজ করতেন। একবার রামাযানের ঘটনা। তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। নিয়ম অনুসারে রোজা রেখেই তিনি খেতের কাজ করতে গেলেন। বিকেলে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন ইফতারের সময় হয়ে গেছে। ঘরে এসে স্ত্রীকে বললেন– ওগো! খাওয়ার কী আছে দাও! স্ত্রীর নির্বিকার উত্তর, দেওয়ার মতো কিচ্ছু নেই! আচ্ছা অপেক্ষা কোরো, দেখি কারও ঘরে কিছু পাওয়া যায় কি না! কথাগুলো বলে হারিস ইবনু সিরমাহ রাযি.-এর স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর ওইদিকে তিনি সারাদিনের কাজে ক্লান্ত শরীর চাটাইয়ে এলিয়ে দিলেন। যে-ই চাটাইয়ে গা এলালেন, চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এল। তিনি অন্যজগতে হারিয়ে গেলেন। স্ত্রী ঘরে ফিরে স্বামীকে ঘুমে দেখে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, হায় হায়! হারিস ধ্বংস হয়ে গেছে! হারিস ধ্বংস হয়ে গেছে! ((কারও নিশ্চিত বিপদ দেখে আফসোস প্রকাশের জন্য এরকম বলা আরবের রীতি ছিল।))
কারণ সে সময় ইসলামি শরিয়াহর নিয়ম ছিলো— ইফতারের পর থেকে ওই রাত্রে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যা খাওয়ার, যা ভোগ করার—করে নিতে হবে। একবার ঘুমিয়ে গেলে আ-র সুযোগ নেই। ওই রাত্রে ঘুম থেকে জাগলেও হবে না। বরং পরবর্তী ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
যাইহোক, হারিস ইবনু সিরমাহ রাযি. ঘুম থেকে জাগলেন। কিন্তু শরিয়াহ মুতাবিক কোনোকিছু খাওয়ার বা পান করার সুযোগ পেলেন না। পরদিন তাই অনাহার থেকেই রোজা রাখা শুরু করলেন। অন্যদিকে নিয়ম অনুসারে ওইদিনও খেতের কাজে মাঠে গেলেন। টানা দুইদিনের দানাপানিহীন দেহ মধ্যদিনেই ভেঙে পড়ে। পিপাসার তাড়নায় তিনি বেহুঁশ হয়ে যান!…
এটুকু পর্যন্ত দীন পালনে তার ত্যাগ স্বীকারের গল্প হলেও পরেরটুকু প্রতিদানের।
কারণ পরক্ষণেই রাতের বেলা খানাপিনার সুযোগ দিয়ে উপরিউক্ত আয়াতটির কিছু অংশ নাযিল হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ!
মোমেন্টগুলো খুবই ক্রিটিকাল প্লাস এক্সাইটিং। একটা মানুষ খাবারের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে, আবার না খেয়েই মাঠে কাজ করতে যাচ্ছে, কাজে থাকতে থাকতেই বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছে। আর বেহুঁশ হওয়াতেই নাকি ঐশীবাণী অবতীর্ণ হচ্ছে।…
আমার কিশোর মনের কোমল দরজায় বারবার করাঘাত করছিলো—কী সে গোপন বল্, যা হারিস ইবনু সিরমাহ-কে এ কঠিন পথের দিকে আকর্ষণ করেছিল? কোন সে খাদহীন টান, যা তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল? এ কেমন ইখলাসপূর্ণ ইবাদত, যেখানের কষ্ট লাঘব করতে স্বয়ং কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছে? এরকম বহু প্রশ্ন উঁকি দিলেও, ঘুরেফিরে উত্তর এই একটাই আসছিলো—দীনের টান, দীনদারির ভালোবাসা তাকে এমন বেপরোয়া করে তোলেছিলো, তাকে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বিশেষিত করেছিল।
ঘটনার দুইটা দিক আমার কিশোর মনে গেঁথে গিয়েছিল।
• এক. দীন পালনে তার অসম্ভব কষ্ট স্বীকার।
• দুই. কষ্টের প্রতিদান হিসেবে ঐশীকালাম অবতীর্ণ হয়ে যাওয়া।
দ্বিতীয় দিকটা প্রভাব ফেলেছিলো বেশি। একজন মানুষ একটা কঠিন সিচিউশানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আর এ থেকে উত্তরণের জন্য স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কথা বলছেন। সহজতা অবতীর্ণ করছেন। কী পরম সৌভাগ্য! আবেগে সেদিন আমার চোখের পাতা ভিজে গিয়েছিল!
বাকি জীবনে দীন পালনে কষ্ট সহ্য করার পাশাপাশি অনাবিল প্রতিদিন পাওয়ার একটা বিশ্বাস হৃদগভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো সেদিন থেকে।
আলহামদুলিল্লাহ!
রোজা রাখে না, রোজা ভেঙে খাচ্ছে—এমন অনেক মানুষের সাথে আমাদের প্রতিদিনই সাক্ষাৎ হয়। রিকশা চালাচ্ছে, পাথর টানছে, মাটি কাটছে, শিল্পকারখানায় কাজ করছে—এমন কঠিন পেশার মানুষজনের সাথে দেখা হলে এ গল্পগুলো বলা যায়।
দীন পালনে অভাবনীয় কষ্ট স্বীকারের এ গল্পগুলো যেভাবে তাদের বিবেককে নাড়া দেবে, তেমনই এ কষ্টের প্রতিদান হিসেবে অনিঃশেষ কিছু পাওয়ার সম্ভাবনাও তাদের জীবনে আশার প্রদীপ জ্বালাবে।
ইনশাআল্লাহ!
লেখক: মাসরুর আহমাদ