
জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত তৎকালীন আরব সমাজ ৷ শহর গ্রাম সর্বত্রই জাহেলিয়াতের চিহৃ ৷ সৃষ্টাবিমুখ অবিশ্বাসীদের পদচারণা সেখানে ৷ মূর্খতা, ধূর্ততা, শঠতার কুহেলিকায় আকুন্ঠ ডুবে ছিল সে সমাজ ৷ ছিল না নারী অধিকার, পরিবার ব্যবস্থার স্থায়ী আইন, সম্পদের সুষম বন্টন, অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো নির্দেশনা, জাতীয় সংকট উত্তরণের স্থায়ী সমাধান, জীবনের পরম উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ৷ সৃষ্টা সম্পর্কে নানাবিধ কুসংস্কারে বিশ্বাস, উপাসনায় সৃষ্টার সাথে একাধিক মিথ্যা উপাস্যের পার্টনারশীপ গ্রহণ, বাইতুল্লাহর মতো পবিত্রতম জায়গায় শুধুমাত্র কৌলিন্য রক্ষার জন্য কুরাইশ ছাড়া অন্য গোত্রের লোকদের উলঙ্গ করে তাওয়াফ করা, পবিত্র কাবাগৃহের অভ্যন্তরে তিনশ ষাটটি মূর্তি স্থাপন- এসবই ছিল তাদের ইবাদত উপাসনার ধরণ প্রকৃতি ৷ সুদ, লটারী, জুয়া, বাজি এসব ছিল জাহেলী যুগের লোকদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার ৷ অনেকে এসব করেই আয় রোজগার করত ৷ ইহুদিরা সুদের প্রচলনের জন্য আগে থেকেই সকলের ঘৃণার পাত্র ছিল ৷ অনেকে অসহায় হয়ে তাদের কাছ থেকে চড়া মূল্যের সুদ নিত ৷ পান থেকে চুুুন খসলেই বেজে উঠত যুদ্ধের দামামা ৷ খুব তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলত যুগের পর যুগ যুদ্ধ ৷ সে সমাজে গোত্রপতিদের কথাই ছিল আইন ৷ ইলাহী কোনো আইনের সন্ধান তারা তখনও পায় নি ৷ ওহীভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কথা ছিল কল্পনাতীত ৷ ফলে সেখানে বিরাজ করছিল অস্থীরতা, অরাজকতা, যুলুম অত্যাচার ৷
আমরা আজকের লেখায় খুব সংক্ষিপ্তাকারে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত জাহেলী সমাজের দশটি চিত্র তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ ৷
১. পরকালে অবিশ্বাস :
জাহেলী যুগে কাফের মুশরিকদের যতগুলো অবিশ্বাস ছিল তন্মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল পরকালে অবিশ্বাসের বিষয়টি ৷ আল্লাহ বলেন:
وَقَالُوا مَا هِىَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَآ إِلَّا الدَّهْرُ ۚ وَمَا لَهُم بِذٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
“এরা বলেঃ জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এই জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদের ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোন জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে এসব কথা বলে।” [সূরা আল জাসিয়া, ৪৫/২৪]
এজন্যই পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন সূরায় অসংখ্যবার তাদের এই অবিশ্বাসের খণ্ডন করা হয়েছে যৌক্তিকভাবে ৷ মাক্কী সূরাসমূহ অধ্যয়ন করলেই আমরা এর বাস্তবতা দেখতে পাব ৷ এছাড়াও কুরআনের অনেক জায়গায় এই বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে ৷ আল্লাহ বলেন:
وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِىَ خَلْقَهُۥ ۖ قَالَ مَن يُحْىِ الْعِظٰمَ وَهِىَ رَمِيمٌ
“এখন সে আমার ওপর উপমা প্রয়োগ করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায় বলে, এ হাড়গুলো যখন পচে গলে গেছে এতে আবার প্রাণ সঞ্চার করবে কে?” [সূরা ইয়া সীন, ৩৬/৭৮]
আল্লাহ তায়ালা এর জবাবে বলেন:
قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِىٓ أَنشَأَهَآ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ
“তাকে বলো, এদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ জানেন।” [সূরা ইয়া সীন, ৩৬/৭৯]
২. মূর্তিপূজা :
মূর্তিপূজাই ছিল তৎকালীন আরবের ধর্ম পালনের চূড়ান্ত রুপ ৷ সকলের গৃহেই শোভা পেত মূর্তি ৷ বিপদে পড়লে, সফরে যাবার আগে, ব্যবসায়িক উন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে তারা সকলেই স্মরণাপন্ন হত পাথরের তৈরী নির্জীব মূর্তির ৷ হোবল, লাত, মানাত, উজ্জা ছিল সবচেয়ে নামকরা ৷ এমনকি পবিত্র কাবাগৃগের অভ্যন্তরে তারা তিনশ ষাটটি মূর্তি স্থাপন করেছিল ৷ মোটকথা মূর্তিই ছিল তাদের ইলাহ, মা’বুদ, বিপদ থেকে উদ্ধারকারী ত্রানকর্তা সবকিছু ৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন:
أَفَرَءَيْتُمُ اللّٰتَ وَالْعُزّٰى وَمَنٰوةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرٰىٓ أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنثٰى تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيزٰىٓ إِنْ هِىَ إِلَّآ أَسْمَآءٌ سَمَّيْتُمُوهَآ أَنتُمْ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطٰنٍ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنفُسُ ۖ وَلَقَدْ جَآءَهُم مِّن رَّبِّهِمُ الْهُدٰىٓ
“এখন একটু বলতো, তোমরা কি কখনো এ লাত, এ উয্যা এবং তৃতীয় আরো একজন দেবতা মানাতের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছো? তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তান কি আল্লাহর জন্য? তাহলে এটা অত্যন্ত প্রতারণামূলক বন্টন।
প্রকৃতপক্ষে এসব তোমাদের বাপ-দাদাদের রাখা নাম ছাড়া আর কিছুই না। এজন্য আল্লাহ কোন সনদপত্র নাযিল করেননি। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ শুধু ধারণা ও প্রবৃত্তির বাসনার দাস হয়ে আছে। অথচ তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে হিদায়াত এসেছে।” [সূরা আন নাজম, ৫৩/১৯-২৩]
৩. গোত্রীয় শাসনব্যবস্থা, কবিলা প্রধানের কথাই আইন :
আমরা জানি, সে সময় আরবের লোকেরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল ৷ প্রত্যেক গোত্রেই একজন করে রঈস, শায়খ বা গোত্রপতি ছিল ৷ তিনি যা বলতেন তাই তার গোত্রের জন্য আইন হিসেবে বিবেচিত হত ৷ এক্ষেত্রে তিনি বিদ্রোহের শংকায় জনগন সমর্থন করে না এমন কোনো আইন পাশ করতেন না ৷ মোটকথা জনগনের সেন্টিমেন্ট বুঝে তিনি আইন বলবৎ করতেন ৷ যাকে আধুনিক রাজনীতিবিদগণ বলেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস ৷ তাদের সেই আইন বা নিয়মরীতিতে সবলদের কথাই গ্রহনযোগ্যতা পেত বেশী ৷ কারণ মক্কার জাহেলী পার্লামেন্ট দারুন নদওয়ার সদস্যপদ লাভ করত সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই ৷ মহান আল্লাহ বলেন:
أَفَحُكْمَ الْجٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ
“(যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াতের ফায়সালা চায়? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল ফায়সালাকারী আর কেউ নেই।” [সূরা আল মায়িদা, ৫/৫০]
এজন্যই আল্লাহর আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহপোষণকারী ব্যক্তিকে বেঈমান বলা হয়েছে ৷ আল্লাহ বলেন:
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتّٰى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِىٓ أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“না, হে মুহাম্মাদ! তোমার রবের কসম, এরা কখনো মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ এদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে এরা তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে, তারপর তুমি যা ফায়সালা করবে তার ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্য যে কোনো প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।” [সূরা আন নিসা, ৪/৬৫]
একজন মু’মিনের উচিত হলো আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রদত্ত বিধান শোনামাত্রই অকুন্ঠচিত্তে তা মেনে নেয়া ৷ আল্লাহ বলেন:
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِينًا
“যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোন অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।” [সূরা আল আহযাব, ৩৩/৩৬]
৪. সুদী কারবার :
সুদের জন্য ইহুদিরা ছিল বিখ্যাত ৷ তারা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের লেনদেন করত ৷ জাহেলি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনেকেই তাদের দেখাদেখি এই কারবারে দড়িয়ে পড়েছিল ৷ আব্বাস রাঃ সুদের কারবার করতেন ৷ বিদায় হজ্জের সময় রাসূল সাঃ সকল প্রকার সুদী লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ৷ সর্বপ্রথম আব্বাস রাঃ এর সুদের টাকা মওকুফ করে দেন ৷ পবিত্র কুরআনে এসেছে:
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبٰوا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِى يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطٰنُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوٓا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبٰوا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبٰوا ۚ فَمَن جَآءَهُۥ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِۦ فَانتَهٰى فَلَهُۥ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُۥٓ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولٰٓئِكَ أَصْحٰبُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خٰلِدُونَ
“কিন্তু যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থায় উপনীত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলেঃ “ব্যবসা তো সুদেরই মতো।” অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির কাছে তার রবের পক্ষ থেকে এই নসীহত পৌঁছে যায় এবং ভবিষ্যতে সুদখোরী থেকে সে বিরত হয়, সে ক্ষেত্রে যা কিছু সে খেয়েছে তাতো খেয়ে ফেলেছেই এবং এ ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ হয়ে গেছে। আর এই নির্দেশের পরও যে ব্যক্তি আবার এই কাজ করে, সে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে সে থাকবে চিরকাল।” [সূরা আল বাকারাহ, ২/২৭৫]
৫. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা :
তৎকালীন বাইজান্টান এবং পারস্য সাম্রাজ্য ছিল আরব ভূখণ্ডের চোখের সামনে ৷ তাদের ধন সম্পদের প্রাচুর্যতা, বিলাসিতা, রাজকীয় চালচলন সেকালে জাহেলি সমাজের লোকদের মনেও রেখাপাত করেছিল ৷ বিলাসিতার জন্য দেশ বিদেশে ভ্রমন, অপচয়, মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস এসবই ছিল বাইজান্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের ব্যাপার ৷ চোখ ধাঁধাঁনো প্রাসাদ, অন্দরমহলে রমণীদের বিলাসবহুল সাজসজ্জা ইত্যকার বিষয়ের খবর আবরবাসীদের অজানা ছিল না ৷ আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীকে এসব বিলাসিতা থেকে সতর্ক করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় স্থীতিশীলতার জন্য এসব যে কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় নয় বরং ক্ষতিকর সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلٰى مَا مَتَّعْنَا بِهِۦٓ أَزْوٰجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقٰى
“আর চোখ তুলেও তাকাবে না দুনিয়াবী জীবনের শান-শওকতের দিকে, যা আমি এদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের লোকদেরকে দিয়ে রেখেছি। এসব তো আমি এদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি করার জন্য দিয়েছি এবং তোমার রবের দেয়া হালাল রিযিকই উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী।” [সূরা ত্ব হা, ২০/১৩১]
আল্লাহ আরো বলেন:
لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِى الْبِلٰدِ مَتٰعٌ قَلِيلٌ ثُمَّ مَأْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ ۚ وَبِئْسَ الْمِهَادُ
হে নবী! দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আল্লাহর নাফরমান লোকদের চলাফেরা যেন তোমাকে ধোঁকায় ফেলে না দেয়। এটা নিছক কয়েক দিনের জীবনের সামান্য আনন্দ ফূর্তি মাত্র। তারপর এরা সবাই জাহান্নামে চলে যাবে, যা সবচেয়ে খারাপ স্থান। [সূরা আলে, ৩/১৯৬-১৯৭]
৬. সাহিত্যমেলা/ অশালীন কাব্য চর্চার প্রতিযোগিতা :
জাহেলি আরবের সাহিত্য আধুনিক আরবী সাহিত্যের পণ্ডিতদের নিকটে অমূল্য রত্ন ৷ তাদের সাহিত্যচর্চা, বিশেষত কাব্যপ্রতিভা সর্বজনবিদিত ৷ তায়েফের নিকটবর্তী ওকায মেলায় প্রতিবছর সেরা প্রতিভাবান কবিদের কবিতা পাঠের প্রতিযোগিতা হত ৷ সেখান থেকে সেরা সাত জন কবির কবিতা পবিত্র কাবাগৃহের দেয়ালে লটকিয়ে রাখা হতো সেগুলোকে একসাথে বলা হত ‘সাবআ মুআল্লাকা’ বা সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকা ৷ সাবআ মুআল্লাকা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরবী সাহিত্যের সুখপাঠ্য ৷ কিন্তু সেসব কবিতা অশ্লীলতায় ভরপুর ছিল, নারীদেহের সৌন্দর্য বর্ণনা সেসব কবিতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ৷ কামোদ্দীপক সেসব কবিতার বর্ণনা মুখে আনাও লজ্জাকর ৷ কবিদের নামে আল্লাহ তায়ালা একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেন ৷ তাদের ভবঘুরে অবস্থা, সব বিষয়ে কবিতা রচনার প্রচেস্টার নিন্দা করে আল্লাহ বলেন:
وَالشُّعَرَآءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُۥنَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِى كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ إِلَّا الَّذِينَ ءَامَنُوا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَذَكَرُوا اللَّهَ كَثِيرًا وَانتَصَرُوا مِنۢ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا ۗ وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوٓا أَىَّ مُنقَلَبٍ يَنقَلِبُونَ
“আর কবিরা! তাদের পেছনে চলে পথভ্রান্ত যারা। তুমি কি দেখো না তারা উপত্যকায় উপত্যকায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় এবং এমনসব কথা বলে যা তারা করে না? তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরন করে আর তাদের প্রতি জুলুম করা হলে শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়। —আর জুলুমকারীরা শীঘ্রই জানবে তাদের পরিণাম কি!” [সূূূরা আশ শুআরা,২৬/২২৪-২২৭]
৭. নারীজাতির সম্মান লুন্ঠন, তাদেরকে ভোগের বস্তুতে পরিণত :
জাহেলি আরবে নারীদের অবস্থা ছিল বর্তমান সময়ের মতই শোচনীয় ৷ তারা ছিল কেবল ভোগের বস্তু ৷ সম্মান, ইজ্জত, অধিকার, মতামত ইত্যাদি বিষয়াদিতে তাদের মূল্যহীন মনে করা হত ৷ সম্পত্তিতে ছিল না কোনো অধিকার ৷ মেয়ে সন্তানকে কুলক্ষণা মনে করা হত ৷ অনেকে মেয়ে সন্তান হলে তাকে জীবন্ত কবর দিত ৷ স্বাধীন মহিলারা নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য রাস্তায় খোলামেলা চলত ৷ মহান আল্লাহ সেটাকে জাহেলিয়াত হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাত্থেকে মুসলিম।
মহিলাদেরকে সতর্ক করে বলেন:
وَقَرْنَ فِى بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجٰهِلِيَّةِ الْأُولٰى ۖ وَأَقِمْنَ الصَّلٰوةَ وَءَاتِينَ الزَّكٰوةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
“নিজেদের গৃহ মধ্যে অবস্থান করো । এবং পূর্বের জাহেলী যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না । নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো। আল্লাহ তো চান, তোমাদের নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে।” [সূরা আল আহযাব, ৩৩/৩৩]
অন্যদিকে, গানের আসরে মাতাল পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী দাসীরা প্রস্তুত ছিল ৷ স্বাধীনা নারীরা সাধারণত গান বাজনা করে পুরুষের মনোরঞ্জনের বস্তু ছিল না ৷ আধুনিক জাহেলিয়াত এক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়েছে ৷
৮. মদ জুয়ার আসর : নৈতিকতার ক্ষুত পিপাসায় কাতর :
মদ ব্যাতিত আরবের লোকদের জীবন চিন্তাও করা যেত না ৷ নিত্য সঙ্গী ছিল তাদের এই নেশাজাত দ্রব্যটি ৷ সারারাত গানের আসরে সুন্দরী রমণীদের কমনীয় রুপ লাবণ্যে বিভোর হয়ে নিজেদের বুদ্ধি বিবেককে নারী ও মদের হাতে সোপর্দ করে দিত তারা ৷ আরবী সাহিত্যের কবিতায় মদ নিয়ে যে কত বর্ণনা এসেছে তার ইয়ত্তা নেই ৷ মদের নেশা এতই প্রকট ছিল যে, ইসলামী শরীয়তে প্রায় চারটি ধাপে মদকে চূড়াম্তভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে ৷ প্রথমবারেই হারাম ঘোষণা হলে অনেক মুসলমানের জন্য তা মানা কষ্টকর হত ৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلٰمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطٰنِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে।” [সূরা আল মায়িদা, ৫/৯০]
৯. জাতীয়তাবাদ :
জাতীয়তাবাদ ছিল আরব জাহেলিয়াতের রাজনৈতিক বিশ্বাস ৷ আধুনিক যুগে জাতীয়তাবাদ হলো একটি দেশ, অঞ্চল বা ভূখন্ডের জন্য চূড়ান্ত বিশ্বাস পোষণ করা, তার জন্য লড়াই করা, যুদ্ধ করা, প্রাণ বিসর্জন দেয়া তা ন্যায় হোক বা অন্যায় ৷ তৎকালীন জাতীয়তাবাদ ছিল গোত্রীয় জাতীয়তাবাদ ৷ নিজ কবিলার জন্য প্রাণোৎসর্গ করা, নিজ কবিলার জন্য লড়াই করা তা ন্যায় হোক বা অন্যায় ৷ আধুনিক জাতীয়তাবাদের ব্যাপ্তি একটু বড়, দেশ বা মহাদেশ পর্যন্ত তা গড়িয়েছে ৷ তৎকালীন জাতীয়তাবাদ ছিল গোত্র কেন্দ্রীক ৷ তবে কখনে কখনো উদ্দেশ্যের অভিন্নতার কারণে অনেকগুলো গোত্র একই অবস্থান গ্রহণ করত ৷ যেমন আহযাবের যুদ্ধের সময় ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের গোত্রগুলোর সামরিক জোট ৷ জাতীয়তাবাদের নিন্দা করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِى قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجٰهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلٰى رَسُولِهِۦ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوٰى وَكَانُوٓا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا ۚ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمًا
“এ কারণেই যখন ঐ সব কাফেররা তাদের মনে জাহেলী সংকীর্ণতার স্থান দিল তখন আল্লাহ তাঁর রসূল ও ঈমানদারদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে তাকওয়ার নীতির ওপর সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখলেন। তারাই এ জন্য বেশী উপযুক্ত ও হকদার ছিল। আল্লাহ সব জিনিস সম্পর্কেই পরিজ্ঞাত।” [সূরা আল আহযাব, ৪৮/২৬]
১০. পূর্বপুরুষের কর্মনীতির অন্ধ অনুসরণ :
তাকলীদুল আ- বা ওয়াল আজদাদ বা বাপ দাদার অন্ধ অনুসরণ আরব জাহেলিয়াতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট ছিল ৷ তাদেরকে যখন কুরআনের বাণী শোনানো হতো তারা বলত আমরা এসব কিছু বুুুঝি না, আমরা তা-ই অনুসরণ করব যা আমাদের বাপ দাদারা রেখে গেছে ৷
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَآ أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَآ أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ ءَابَآءَنَآ ۗ أَوَلَوْ كَانَ ءَابَآؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْـًٔا وَلَا يَهْتَدُونَ
“তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তা মেনে চলো, জবাবে তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাদের যে পথের অনুসারী পেয়েছি আমরা তো সে পথে চলবো। আচ্ছা, তাদের বাপ-দাদারা যদি একটুও বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ না করে থেকে থাকে এবং সত্য-সঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থাকে তাহলেও কি তারা তাদের অনুসরণ করে যেতে থাকবে?” [সূরা আল বাকারা, ২/১৭০]
পূর্বপুরুষের অনুসরণ তখনই প্রশংসনীয় যখন তা সঠিক কর্মনীতি তথা ইলাহী নির্দেশনার উপরে প্রতিষ্ঠিত ৷ ইলাহী নির্দেশনা বা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান, যুক্তি, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো যদি বাপ দাদার কর্মপন্থায় অনুপস্থিত থাকে তাহলে সেটাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা বা সেটার দিকে ফিরে যাওয়ার নামই হলো জাহেলিয়াত ৷
এখানে এমন দশটি জাহেলি বিশ্বাস, কর্মনীতি, কর্মপন্থা তথা ইসলামপূর্ব আরবের অবস্থান কুরআনের আলোকে তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি প্রায় সবগুলো মুসলিম দেশেই বিদ্যমান ৷ বিজ্ঞ পাঠক তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন বলে আমি আশাবাদী ৷ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল প্রকার জাহেলিয়াতের রেড়াজাল, মায়াজাল ছিন্ন করে দ্বীনে খালেসের পথে চলার তাওফীক দিন। আমীন ৷