রাতে ঘুম হয় না

চোখ ঝলসে দেওয়া প্রযুক্তি-বিপ্লবের যুগে সবচেয়ে কমন যে রোগ মানুষের মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে তা হলো— রাতে ঘুম না হওয়া।

সম্ভবত পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ এই ‘ঘুম হয় না’ রোগে আক্রান্ত।

হতাশায় জর্জরিত হলে, চিন্তায় অস্থির থাকলে, জীবন নিয়ে ভীষণ দো’টানায় নিপতিত হলে মানুষের চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়। কিন্তু বর্তমান দুনিয়ায় চোখ থেকে ঘুম পালানোর বড় কারণ এসব নয়। এখন মানুষের যতোটাই না ‘ঘুম হয় না’, তারচেয়ে বেশি এখন মানুষ মূলত ‘ঘুমাতে চায় না’।

তবে, এই ‘ঘুমাতে না চাওয়া’ ব্যাপারটা ঐচ্ছিক কিছু নয়। কেউ যে ইচ্ছে করে ঘুমায় না তা কিন্তু বলা যাবে না। গড়ে প্রায় প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের হাতে থাকা একটা করে স্মার্টফোন আজকাল চোখ থেকে ঘুম উধাও হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ।

স্মার্টফোন আছে কিন্তু তাতে ফেইসবুক-ইউটিউব নেই— এমন ঘটনা রীতিমতো অসম্ভব!

ফেইসবুক-ইউটিউবের এলগরিদম এমনভাবে সাজানো, তা খুব সহজেই একজন মানুষকে আটকে রাখতে পারঙ্গম। যেকেউ খুব সহজেই, অনেকটা নিজের অজান্তেই, এখানে পার করে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একটা ইস্যু চাঙা হলে সেটা নিয়ে একটা পোস্ট পড়ে, কিংবা একটা প্রতিক্রিয়া দেখে, অথবা কেবলমাত্র একটা ভিডিও দেখে কেউ নিজেকে নিবারণ করতে পারে না। তাকে দেখতে হয় অন্য অনেকের অভিমত, অন্য অনেকের প্রতিক্রিয়া। এই অভিমত-প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে তাকে ভার্চুয়ালে স্ক্রলের পর স্ক্রল করতে হয়।

এভাবে, একসাথে অনেক তথ্য মস্তিষ্কে ধারণের ফলে তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ তখন বহুগুণে বেড়ে যায় এবং তা নিয়ে মস্তিষ্ক ব্যস্ত হয়ে পড়ে দারুনভাবে। মস্তিষ্কের এই ক্রিয়াকলাপের ফলে তার স্বাভাবিক যে ঘুমের সময় তাতে তখন ব্যাঘাত ঘটে। তথ্যগুলো মাথার মধ্যে কুটকুট করতে থাকায় তার চোখ থেকে ঘুম তখন তল্পিতল্পা নিয়ে বিদেয় হয়।

এছাড়াও, স্ক্রীন থেকে নির্গত হওয়া নীল আলো আমাদের চোখের ওপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রীনে চোখ ডুবিয়ে রেখে ফেইসবুকিং কিংবা ইউটিউব স্ক্রলিংয়ের ফলে আমাদের চোখ থেকে স্বাভাবিক ঘুমের আবহ কমে যায় অনেকাংশে। মাথাব্যথা, উত্তেজনা, অস্থিরতা সহ নানান মানসিক রোগের কারণও স্ক্রীন থেকে নির্গত এই নীল আলো।

আমরা সঠিক সময়ে ঘুমাতে চাই ঠিকই, কিন্তু একইসাথে ভার্চুয়ালের নেশা ছাড়াটাও আমাদের পক্ষে ভীষণ দুরূহ। এজন্যেই ঘুমাতে না চাওয়াটা আমাদের ঐচ্ছিক রোগ নয়, এটা অভ্যাসগত একটা চর্চা এবং এই চর্চা ধীরে ধীরে আমাদের ওপরে ঝেঁকে বসেছে ভীষণভাবে।

এই ‘ঘুম হয় না’ রোগ সারাতে কেউ কেউ ঘুমের ওষুধ খায় হয়তো, কিংবা কেউ কেউ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্নও হয়— কীভাবে এই বদ-অভ্যাস দূর করা যাবে, কীভাবে সঠিক সময়ে ঘুমানো যাবে ইত্যাদি ব্যাপারে।

তবে, এই রোগের চিকিৎসা পেতে আপনি যদি ফুযাইল ইবন ‘আয়ায রাহিমাহুল্লাহর শরণাপন্ন হোন, তিনি আপনাকে হাতে ধরিয়ে দেবেন একেবারে সহজ একটা প্রেসক্রিপশন। আশা করা যায়, সেই প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে পারলে আপনার এই ‘ঘুম হয় না’ রোগ সম্পূর্ণভাবে সেরে যাবে, আল্লাহ চান তো।

তো, কী সেই প্রেসক্রিপশন?

তাঁর সুন্দর একটা নাসীহাহ আছে। তিনি বলেছেন:

‘ইস্তিগফারের চাইতে বিস্ময়কর এবং মনো-স্বস্তিদায়ক আর কোনোকিছুই আমি খুঁজে পাইনি। এমনকি, কেউ যদি বলে রাতে তার ঘুম হয়না, সে যদি নিবিষ্টমনে ইস্তিগফার করতে থাকে, তাহলে শয়তানও চায় যে সে জেগে না থেকে বরং ঘুমিয়ে পড়ুক। কারণ— জেগে থাকলে সে ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজের গুনাহ কমিয়ে নিচ্ছে, এবং নেকির দ্বারা ভারি করে নিচ্ছে তার আমলনামা। তার চাইতে, ওই ব্যক্তির ঘুমিয়ে পড়াটাকেই শয়তান অধিক পছন্দ করে এবং তাকে (ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারে) সহযোগিতা করে’।

এই প্রেসক্রিপশন খুবই সহজ-সাধারণ, কিন্তু বিশেষ কার্যকরী। রাতে আমরা যারা ঘুমাতে পারিনা, হোক তা ভার্চুয়ালের নীল জগতে অবিরাম বিচরণ, অথবা বিভিন্ন খোশালাপ, অহেতুক আড্ডাবাজির কারণে, আমরা যদি ফুযাইল ইবন ‘আয়ায রাহিমাহুল্লাহর এই নাসীহাহটা মেনে চলতে পারি, আমাদের ‘ঘুম আসে না’ রোগ অচিরেই সেরে যাবে বলে আশা করা যায়, ইন শা আল্লাহ।

তাহলে আমাদের কাজ কী?

রাতের বেলা ঘুমানোর নির্দিষ্ট সময়গুলোতে যখন আমাদের চোখ থেকে ঘুম পালায়, আমরা যখন এ’পাশ-ও’পাশ ফিরে ফেইসবুক আর ইউটিউব স্ক্রল করি, তখন যদি নিবিষ্টমনে, ধীর-চিত্তে আমরা ইস্তিগফার পাঠ করি, তখন ম্যাজিকের মতো আমাদের চোখে ঘুম নামবে, ইন শা আল্লাহ।

শয়তান তখন চাইবেই না যে আপনি জেগে থাকুন। জেগে থাকলে আপনি যিকিরে থাকছেন। আর, আপনি আল্লাহর স্মরণে মশগুল আছেন— এমন দৃশ্য শয়তানের জন্য বড়োই কষ্টের‍!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *